উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব শাসন করেছে ব্রিটেন, বিংশ শতাব্দীতে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে পুনর্গঠনের নামে ব্যাপক অর্থায়ন করে শাসন ও শোষন করছে যুক্তরাষ্ট্র; ধারণা করা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দী হবে চীনের। প্রায় ২০০০ বছর আগে হান রাজবংশের সময় প্রতিষ্ঠিত “সিল্ক রোড” এর ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ২০১৩ সালে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্বজুড়ে দরিদ্র দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন তার আধিপত্য বিস্তার করে চলছে।
বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) উন্নয়নের নামে বিশ্ব ব্যাপী অর্থনৈতিক কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা ও চীনের নিজস্ব বাণিজ্য সুসংহত করার পরিকল্পনায় মত্ত। চীন রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নয়, বিশ্ব শাসন করতে চাইছে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে। বিআরআই এর ইতোপূর্বে আরও দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ ১৮ অক্টোবর থেকে চীনের বেইজিংয়ে তৃতীয় সম্মেলন শুরু হবে, ১৯০টির ও বেশি দেশেকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে এই সম্মেলনে। বাংলাদেশ প্রথম ২০১৬ সালে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে যোগ দেয় । অনেকের ধারণা চীন এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলোতে বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে চায়। এর জ্লজ্যান্ত উদাহরণ শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দর। ছাড়াও লাওস,অ্যাংগোলা, জিবুতি, কেনিয়া,মালদ্বীপ, পাকিস্তান ইতোমধ্যে চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ বিআরআই প্রকল্পে সমর্থন জানিয়েছে। সে কারণে চীনা সরকার বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে অর্থ বিনিয়োগ করছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখে শুনে সম্মত হওয়া। নয়তো বাংলাদেশকে শ্রীলংকার (হাম্বানটোটা বন্দরের) মত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। বিশ্বব্যাপী চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে ইউরোপীয় কমিশনের রাষ্ট্রপতি উরসুলা ফন ডার লেইন বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ চালু করার মাধ্যমে বিশ্বের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে চীন। তারা প্রায়ই প্রতিকূল শর্তে এবং অস্বচ্ছ উপায়ে বিনিয়োগ করে থাকে যা দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলে চীনের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে। উন্নয়নের নামে বাংলাদেশ-কে প্রকাশ্য ও গোপন ঋণের ফাঁদে ফেলে সুদ বাণিজ্য হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত। জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ন করার নামে জীবাশ্ম জ্বালানিতে তার বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশেকে পরনির্ভরশীল করে তোলার পাশাপাশি দেউলিয়াকরনের দিকে ধাবিতে করছে। বিনিয়োগকৃত প্রকল্পে পরিবেশ-প্রতিবেশ-মানবাধিকার-শ্রমাধিকারের তোয়াক্কা না-করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
চীনের প্রেসিডেন্ট সিজিনপিং ২০১৩ সালে মধ্য এশিয়া সফরের সময় কাজাখস্তানের নজরবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক ভাষণে ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’-এর ধারণা দেন। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিশ্বের ১৫০টির বেশি দেশকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তথাকথিত উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে করার পরিকল্পনা আছে এ প্রকল্পের (এক অঞ্চল, এক পথ)। এটিই হচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প, পৃথিবী দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে এ প্রকল্পের অন্তভূর্ক্ত করা, বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এ প্রকল্পে আওতায় এখন পর্যন্ত, চীন ১৫১টি দেশ এবং ৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নির্মাণে ২০০ টিরও বেশি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, সড়ক এবং নৌ পথে চীনকে সমগ্র এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত করা। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের রয়েছে দুটি অংশ- ইকোনমিক বেল্ট এবং মেরিটাইম বেল্ট। প্রকল্পটির আওতায় রয়েছে ৬টি দূরঅভিসন্ধিমূলক ইকোনমিক করিডোর। করিডোরগুলো হলো- বিসিআইএম, সিপিইসি, চীন মঙ্গোলিয়া রাশিয়া ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দো চায়না পেনিনসুলা। যেখানে নদীবন্দর, রাস্তা ও রেল লাইনের উন্নয়ন করে চীনের সাথে মিলিত হতে চলছে। যার মাধ্যমে পৃথিবী যুক্ত হবে দেশটির সাথে। যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে চীনের হাতে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বাড়বে। অনেক অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন; চীন এই বৃহৎ প্রকল্পের আড়ালে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলছে। অবশ্য তাদের এই অভিযোগের পেছনে কিছু শক্ত যুক্তিও রয়েছ। চীনা ঋণ শোধ করতে না-পেরে শ্রীলঙ্কা তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দিয়ে দেয়। কেনিয়ার মোম্বাসা দ্বীপও ৯৯ বছরের জন্য চলে গেছে চীনের কাছে। বিভিন্ন উন্নত দেশের ঋণের শর্তাবলী থেকে চীনের শর্তাবলী বেশ আলাদা। তাদের অর্থায়নের উপায় হলো বাণিজ্যের সাথে বিনিয়োগ ও অনুদান একত্রিত করে দেওয়া। বিদেশে বিনিয়োগকারী চীনা সব ব্যাংকই সরকারি মালিকানাধীন। রাষ্ট্রীয়ভাবে চীন সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী এবং তাদের কোম্পানিগুলোই সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, চীনা ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পে শুধুমাত্র চীনা কোম্পানিই প্রতিযোগিতা ও কাজ করতে পারে। তাদের থেকে নেওয়া আর্থিক সহায়তায় যেকোনো প্রকল্প চীনা কোম্পানি দ্বারাই বাস্তবায়িত করা হয়। অর্থাৎ তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তাদের দেশের কোম্পানিকেই দেওয়ার মাধ্যমে নিজেরাই বাণিজ্য করে লাভবান হচ্ছে আর আমাদের মত দেশের ওপরে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ অর্থনীতিবিদ সেবাস্তিয়ান হর্ন ও কারমেন রেইনহার্ট বলেছেন, যেসব দেশ অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে, তারা যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তার ৬০ শতাংশই চীনের কাছ থেকে নেওয়া। তিন মহাদেশের একটি বড় অংশ জুড়ে চীনের এই বিপুল বিনিয়োগে উদ্বিগ্ন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির অনেক দেশ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে চলছে চীন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোতে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে সেখানে নিজেদের একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে চীন। গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দেয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে দেশের দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ৭০.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এক বছর আগে ছিল ৬০.৪১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ঋণের সুদ এবং আসল শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ২০১ কোটি ডলার। গত এক বছরে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে ৭৩ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। ছয় বছর পর ২০২৯-৩০ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ যদি আর নতুন কোনো ঋণ না-নেয় তাহলে ২০৬২ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে । ঋণের সুদ পরিশোধ করতে জাতীয় বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হচ্ছে। দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। এচায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চীনা ঠিকাদারদের কাজের ব্যাপ্তি ৯০২ কোটি ডলার। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮১১ কোটি ডলারের কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। আবাসন, কৃষি, প্রযুক্তি ও ইউটিলিটি খাতে এর পরিমাণ যথাক্রমে ২৩৬, ১২৮, ১১৩ ও ১০৪ কোটি ডলার।। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার। যা পৃথিবীকে উষ্ণায়ণের দিকে ঠেলে দিছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছে দেশ। চীন এই উদ্যোগের মাধ্যমে তার অর্থনীতির জন্য সর্ববৃহৎ ট্রেড প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ তার পণ্য নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন বিশ্বে আরও বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার অর্ধেকই সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়না, যা প্রায়শই সরকারি হিসাবপত্রের বাইরে রাখা হয়। কোনো একটি দেশের সরকারকে দেয়া ঋণকে চীন সরকারের সরাসরি ঋণ হিসেবে না-দেখিয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এবং ব্যাংক, যৌথ প্রকল্প কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া ঋণ হিসেবে দেখানো হয়।
চীন তাদের বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রকাশ করে না, এবং ঋণের ব্যাপারে যেসব চুক্তি হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব না প্রকাশ করার শর্ত দেয়া থাকে। ফলে যারা ঋণ গ্রহণ করে তারাও চুক্তির বিষয়ে কিছু প্রকাশ করে না। এইডডাটার হিসেব অনুসারে, বর্তমানে ৪০টিরও বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ আছে, এসব “গোপন ঋণের” কারণে চীনা ঋণদাতাদের কাছে যাদের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশের চাইতেও বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে, চীনের কাছে জিবুতি, লাওস, জাম্বিয়া এবং কিরগিজস্তানের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ২০ শতাংশের সমান। বাংলাদেশেও চীনা কোম্পানিগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পে বেশ সক্রিয়। চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ৫৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ১২টি রাস্তা, ২১টি সেতু এবং ৫৪১.৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট সাতটি রেললাইন তৈরি করেছে। এছাড়াও, চীনা কোম্পানিগুলো কয়লা, সৌর এবং বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করেছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে পরনির্ভরশীল করে তুলেছে। বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করা হচ্ছে পরনির্ভরশীল জ্বালানি ক্রয়ের জন্য। যদিও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীনা প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিং ঘোষণা দেন যে, চীন আর কোনো নতুন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা করবে না। এর আগে একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকাস্থ চীনাদূতাবাস অর্থ মন্ত্রনালয়ের প্রেরিত এক চিঠিতে জানায় যে, চীন বাংলাদেশে আর কোনো কয়লা খনি বা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করবে না। এরপরেও এক্সিম ব্যাংক পায়রা ফেজ-২ এ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এছাড়াও বিআরআই এর বিনিয়োগ অন্তর্ভূক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলো হলো বাঁশখালী ১২২৪ মেগাওয়াট (SSPL) কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (কন্সট্রাকশন), বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ইউনিট-৩) (অপারেশন) বরিশাল ৩৫০ মেগাওয়াট (BEPCL) কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (অপারেশন), দাউদকান্দি ১৩২০ মেগাওয়াট (মেঘনা) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র (অপারেশন), কোড্ডা ১৫০ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্ট (অপারেশন), পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট (RNPL) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ফেজ-1) (অপারশন), পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট (BCPCL) কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ফেজ-1) (অপারেশন), সৈয়দপুর ১৫০ মেগাওয়াট (অপারেশন)। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে আইসিডিসি সৈয়দপুর ১৫০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ডিজেল চালিত। এছাড়াও পায়রা ১৩২০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা চালিত। দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড আমাদের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। যেহেতু প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে গেছে তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে। তার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক হারে বেড়ে যাচ্ছে। আর তাই গলতে শুরু করছে মেরু অঞ্চলে থাকা বরফ গুলো। মেরু অঞ্চলের বরফ গুলো গলায় কারণে কোস্টাল এরিয়া বা সমুদ্রবর্তী অঞ্চলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে ডুবে যাবে। এগুলো হলো ভবিষ্যতের কথা। ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি চীনা বিনিয়েোগে পরিচালিত প্রকল্প সমূহে নানা বঞ্চনা। উল্লেখ করা যেতে পারে, বেল্ট রোড প্রকল্পের অর্থায়ন যাতে বাংলাদেশকে কোনও ঋণের জালে জড়িয়ে না-ফেলে সে দিকেও বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
২০২১ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালালে অন্তত পাঁচজন নিহত ও অসংখ্য আহত হন। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং একটি গণতান্ত্রিক জাতির জন্য লজ্জাজনক। ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের গুলি করা আইন বিরোধী। পুলিশের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ক্ষমতার বেআইনি ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়, যেখানে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের কাজ। আমরা আরও মনে করিয়ে দিতে চাই যে বাঁশখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এর আগেও ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। সেসব ঘটনায় ছয়জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিল, তবে আমরা সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার দেখতে পাইনি। ২০১৯ সালের ১৮ জুন বিকালে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রর ব্রয়লার থেকে পড়ে নিহত বাঙালি শ্রমিক সাবিন্দ্র দাসের (৩৩) লাশ গুম করার গুজবে বিকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বাঙালি ও চায়না শ্রমিকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত চায়না শ্রমিক নিহত হন। এরপর ২০ জুন রাতে কলাপাড়া থানায় পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করা হয়। পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা পরিচালক ওয়াং লিবিং বাদী হয়ে অজ্ঞাত এক হাজার জনকে আসামি করে এ দুইটি মামলা দায়ের করেন। নির্মাণাধীন পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও এক শ্রমিক হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২২ জুন দুপুরে তাদের কলাপাড়া আদালতে হাজির করা হলে বিচারক জেল হাজতে পাঠান। এমতাবস্থয় আমরা দাবি জানাতে চাই, চীনা লোনের আওতায় পায়রা দ্বিতীয় ফেজ পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট এবং সৈয়দপুর ১৫০ মেগা ওয়াট সহ সকল ফসিল ফুয়েল জ্বালানি ব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করতে হবে। এস আলম গ্রুপ, SEPCO, HTG এর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বাঁশখালি ১২২৪ মেগা ওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিহত ও আহতদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে দায়ীদের বিচার ও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চীনা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্থ বাস্তুচুত শ্রমিক ও জনসাধারণকে যথাযত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিনিয়োগ যদি করতেই হয় তাহলে, বাংলাদেশে ২০৫০ সাল নাগাদ শতভাগ নবায়ণযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষে বিনিয়োগ করতে হবে। জ্বীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
লেখক : বাহলুল আলম
জিবাশ্ম জ্বালানী বিষয়ক অভিজ্ঞ জন
তারিখ : ১৮অক্টোবর ২০২৩