প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচি যা প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন। আজকের শিশুরাই স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিশারী এবং জাতির কান্ডারী।শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতন ও মানবিক মানুষরূপে গড়ে তুলতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীবৃন্দ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কার্যক্রমটি সম্পন্ন করে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে কার্যক্রমটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। SDG এর তৃতীয় অভীষ্ট ‘সুস্বাস্থ্য’ অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রমটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান।
ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচির লক্ষ্যঃ
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন।
ক্ষুদে ডাক্তারদের মূল কাজঃ
১) স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান।
২) কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহের শিশুদের ঔষধ খাওয়ানো।
৩) শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষ।
৪) স্বাস্থ্য বিষয়ক দিবস উদযাপন।
দল গঠনঃ
ক্ষুদে ডাক্তার দল গঠনের জন্য দেশের প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি ক্লাসে/সেকশনের (১ম-৫ম শ্রেণির) জন্য তিনজন করে ক্ষুদে ডাক্তার নির্বাচন করতে হয়। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে চটপটে এবং বাকপটু হওয়ায় ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রমে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।প্রতি ক্লাসে/ সেকশনের জন্য তিনজনের একটি দল হিসেবে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষার্থী ক্ষুদে ডাক্তার হিসেবে বিদ্যালয়ে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় দলের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে ।দল গঠনের ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয়। সামগ্রিক কার্যক্রমটি বিদ্যালয়ের একজন গাইড শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার সরঞ্জামঃ
১) উচ্চতা মাপার ফিতা( স্টিলের স্কেল /দর্জিদের ব্যবহার্য ফিতা অথবা দেয়ালে অঙ্কিত স্কেল ব্যবহার)
২)মূলত দৃষ্টি শক্তি পরীক্ষা চার্ট
৩) ওজন মাপার মেশিন
উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষার্থীদের চিকিৎসকদের ইউনিফর্ম ব্যবহার করা হয়।
সময়ঃ
শিক্ষার্থীরা সাধারণত বছরে দুইবার জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে চেকআপ করে থাকেন। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সরবরকৃত তথ্য সংগ্রহ ফর্ম যেখানে উচ্চতা, ওজন, দৃষ্টি শক্তি, কৃমির ঔষধ সেবন এবং অন্যান্য প্রতিষেধক সংক্রান্ত তথ্য থাকে এবং তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের রোল, নাম, বয়স লেখা থাকে।
ক্ষুদে ডাক্তারদের করণীয়ঃ
১)বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরুর দুই থেকে তিন দিন পূর্বে প্রত্যেক টিম যার যার নির্ধারিত ক্লাসে উপস্থিত হয়ে আগাম ঘোষণা দিবে।
২)ক্ষুদে ডাক্তার কিভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে তার শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখে অনুশীলন করবে।
৩) শ্রেণীভিত্তিক সকল ছাত্র-ছাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করবে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য সংগ্রহ ফর্মে তা লিপিবদ্ধ করে রাখবে।
৪)স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর প্রতিবেদন গাইড শিক্ষককে দেয়া যেমন শ্রেণীভিত্তিক মোট কতজন ছাত্রছাত্রী কতজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে ,শ্রেণীভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীর গড় ওজন ও উচ্চতা এবং অস্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নির্ণয়।
• উচ্চতা মাপাঃ
১) শ্রেণীকক্ষের দেয়ালে বা দরজায় পিতা বা টেপ আটকে দেওয়া।
২)ছাত্রছাত্রীদেরকে একজন একজন করে ডাকা।
৩)স্কেল বরাবার সোজা হয়ে সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো।
৪) দাঁড়ানো অবস্থায় মাথার উপর এবং দেয়ালে দরজায় আটকানো স্কেল বরাবর ৯০ ডিগ্রি কোণ করে আরেকটি স্টিলের স্কেল দিয়ে উচ্চতা মাপা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্মে উচ্চতার ঘরে ইঞ্চি বা সেন্টিমিটারে উচ্চতা লেখা।
• ওজন মাপার পদ্ধতিঃ
১) সমতল জায়গায় ওজন মেশিন রাখা এবং মেশিনের কাটা শূন্যের ঘরে আনা।
২)ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একজন একজন করে ডাকা।
৩) ওজন মেশিনের উপর খালি পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
৪)ওজন মেশিনের সামনাসামনি বসে কাটা পর্যবেক্ষণ করা কারণ এক পাশে বসে পর্যবেক্ষণ করলে ভুল ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫)স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্মের ওজনের ঘরে কিলোগ্রাম এককে ওজন লেখা।
• দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার পদ্ধতিঃ
১)আই চার্ট চোখের সমতলে দেয়ালে টানাতে হবে।
২) আই চার্ট থেকে ছয় মিটার দূরে মেঝেতে একটি দাগ দিতে হবে।
৩) ছাত্রছাত্রীদেরকে একজন একজন করে ৬ মিটার দূরে মেঝেতে দাগ বরাবর দাঁড় করাতে হবে।
৪) প্রথমে বাম হাত দিয়ে বাম চোখ ঢেকে আইচার্টের লেখা পড়ে ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি নির্ণয় করতে হবে। পরে ডান হাত দিয়ে ডান চোখ ঢেকে আইচার্টের লেখা পড়ে বাম চোখের দৃষ্টি শক্তি নির্ণয় করতে হবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে অসুবিধা পরিলক্ষিতের ক্ষেত্রে দৃষ্টি শক্তি অস্বাভাবিক হলে ক্রসচিহ্ন দিয়ে সাথে ডান চোখের ক্ষেত্রে ডান এবং বাম চোখ এর ক্ষেত্রে বাম লিখে পূরণ করতে হবে।
• কৃমিনাশক সেবনের তথ্যঃ
গত রাউন্ড ক্রিমিনাশক সেবন করে থাকলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্ম এর নির্ধারিত জায়গায় টিক চিহ্ন দিতে হবে।সেবন না করে থাকলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্ম এর নির্ধারিত জায়গায় ক্রসচিহ্ন দিতে হবে।
ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য প্রতিষেধকের তথ্য দিতে পারলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফর্ম এর নির্ধারিত জায়গায় টিক চিহ্ন দিয়ে উল্লেখ করতে হবে।
ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের করণীয়:
বছরের শুরুতে খুলে ডাক্তার নির্বাচন এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।ক্ষুদে ডাক্তারের মাধ্যমে কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ উদযাপন।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার তিনটি মূল বিষয় যেমন উচ্চতা ওজন ও দৃষ্টি শক্তি সম্পর্কে জানা।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার পূর্বে ওজন মেশিন আইসারট উচ্চতা মাপার স্কেল বা পিতা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্ম সংগ্রহ করে রাখা।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফর্মে ছাত্রছাত্রীদের নাম লিপিবদ্ধ করা।
ক্ষুদে ডাক্তার কিভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে সে বিষয়ে টিমের প্রত্যেককে হাতে কলমে শিক্ষা বা নির্দেশনা দেয়া।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাস্তবায়নে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া ।
ক্ষুদে ডাক্তারদের দিয়ে দলগতভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা পরিচালনা।
ক্ষুদে ডাক্তারদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন দিবস উদযাপন।
সকল শ্রেণীতে খুঁজে ডাক্তার টিম কর্তৃক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর ক্ষুদে ডাক্তার টিমকে লিখিত প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করা ,সংরক্ষণ ও কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য পাঠানো যেমন-মোট কতজন ছাত্রছাত্রী কতজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে ,ওজন এবং শ্রেণীভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীর গড় ওজন ও উচ্চতা এবং অস্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন শ্রেণী ভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নির্ণয় প্রভৃতি।
লেখকঃ এস,এম,সেরাজুল ইসলাম সবুজ,সহকারী শিক্ষক,মঠবাড়ী সেরাজিয়া সপ্রাবি,কয়রা,খুলনা।